সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা নিত না থানা, সাহেদ দিলে নিত
শিকার হয়ে ইমতিয়াজ উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা মামলা নেয়নি। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের উঁচু পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন ইমতিয়াজ। কিন্তু সেখানে গিয়েও কোনো ফল পাননি। মামলা নেয়নি পুলিশ।
ভুক্তভোগী ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদের প্রতিষ্ঠানে বালু দিয়ে আমি বড় বিপদে পড়ে যাই। সাহেদ নিজের অফিসে ডেকে আমাকে মারধর করে। সাহেদের সঙ্গে থাকা অস্ত্রধারীরা আমাকে মারধর করেন। সাহেদ নিজে আমাকে লাথি মারেন। মারধরের শিকার হওয়ার পরও আমি থানায় গিয়েছি। থানার ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু থানা আমার মামলা নেইনি।’
অবশ্য সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ায় গত ১৯ জুলাই ইমতিয়াজ বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছেন।
উত্তরা পশ্চিম থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সাহেদের বিরুদ্ধে আগে থানায় কেউ মামলা করতে আসেনি।
২০০৯ সাল পর্যন্ত সাহেদের বিরুদ্ধে উত্তরা–পূর্ব থানায় তার বিরুদ্ধে প্রতারণার ৮টি মামলা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি স্বারক জাল করে বুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার অভিযোগে ওই মন্ত্রণালয় উত্তরা–পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন। তবে সাধারণ ভুক্তভোগী কোনো ওই থানায় গিয়ে সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেননি। যারা মামলা করতে গেছেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই কয়দিনে উত্তরা–পশ্চিম থানায় ৭টি মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
থানার রেকর্ড বলছে, সাহেদ সেখানে তার কর্মীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছেন। এই মামলার কারণে পরিবার ভোগান্তিতে পড়েছে দিনের পর দিন।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ গানম্যান নিয়ে চলতেন। ছবি: সংগৃহীতসাহেদের
প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ কোটি টাকার রড দেন আবুল কালাম নামের এক ব্যক্তি। টাকা
চাইতে গেলে উল্টো আবুল কালামকে রিজেন্ট গ্রুপের অফিসে আটকে রেখে নির্যাতন
করা হয়।ভুক্তভোগী আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদ কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়ায়, চকরিয়া, উখিয়ায় সাইক্লোন সেন্টারে সাব কনট্রাক্টে কাজ নিয়েছিলেন। সাহেদ সেখানে আমাদের মাধ্যমে রড-সিমেন্ট দিয়েছিলেন। ওখানে যারা বালু-পাথর-রড দিয়েছিলেন, তাঁদের সবার টাকা আটকে দিয়েছেন। পাওনা টাকা চাইতে আমি সাহেদের অফিসে গেলাম। সাহেদের সঙ্গে থাকা অস্ত্রধারীরা আমাকে অফিসে মারধর করলেন। আমরা উত্তরা পশ্চিম থানায় গেলাম মামলা করতে। কিন্তু থানা কিন্তু আমাদের মামলা নেয়নি। থানা থেকে আমাদের বলা হয়, সাহেদদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা নিতে পারব না। আমরা সাহেদের বিরুদ্ধে থানায় তখন কিন্তু মামলা করতে পারিনি। সাহেদ এখন গ্রেপ্তার হয়েছেন, আমাদের মামলা এখন থানা নিয়েছে।’
২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মো. আলী হোসেন খান।
সাহেদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা না নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘সাহেদ তখন তো আর অত বিখ্যাত কিছু ছিলেন না। আমি উত্তরা পশ্চিম থানায় তিন বছরের মতো ছিলাম। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলাম। আমার সময়ে সাহেদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে গেছেন, এমন কাউকে আমি ফেরত দিয়েছি, এমন কোনো রেকর্ড নেই। আমার থানায় সাহেদের নামে কোনো ওয়ারেন্ট ছিল না। সাহেদকে সবাই যেভাবে চেনেন। আমিও সেভাবে তাকে চিনি। সাহেদের মতো বিতর্কিত লোক এসে আমার কাছে চান্স পেতেন না। সাহেদ আমার থানায় আসতেন না।’
মো. সাহেদ। ছবি: সংগৃহীতব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম হিলালীর টাকাও দেননি সাহেদ। টাকা চাওয়ায় তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। রুপগঞ্জ সেতুর জন্য সাহেদের প্রতিষ্ঠানে বালু সরবরাহ করার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী সাহেদের কোম্পানি গত বছরের ২৬ জুন চার কোটি ৩০ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেয়। চুক্তি অনুযায়ী রফিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান গত বছরের ৩০ জুলাই ১৫ লাখ টাকার বালু দেয়। সাহেদ তখন রফিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠানের নামে একটি চেক দেন। কিন্তু সেই চেক ব্যাংকে ডিসঅনার হয়। চেক জালিয়াতির অভিযোগে সাহেদের নামে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেন। এরপর সাহেদ রফিকুল ইসলামকে হত্যার হুমকি দেন।
ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সাহেদের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টে মামলা করি। মামলা করার পর সাহেদ নিজে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য সাহেদের লোকেরা আমার অফিসে এসে আরেকদফা হত্যার হুমকি দিয়ে যান। সাহেদের যারা বডিগার্ড ছিলেন, তাঁদের সবার কাছে সবসময় অস্ত্র থাকত। আমি কেন মামলা করলাম, এজন্য আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছেন সাহেদ। সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি ভয়ে থাকতাম।’ সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর রফিকুল ইসলাম গত সপ্তাহে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সাহেদের এমন প্রতারণা-জালিয়াতি-অপরাধ সম্পর্কে যাদের জানার দায়িত্ব ছিল, তাঁরা অবহেলা করেছেন। আইনানুগ ব্যবস্থা নেননি। যে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারেননি, তাঁরা কিন্তু ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। যেসব কর্মকর্তা এত দিন সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা নেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন ভুক্তভোগীরা।
মামলা সাহেদের বড় অস্ত্র
রিজেন্ট গ্রুপের জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন আরেফিন সোহাগ। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার সময় সাহেদের নানা-অপকর্ম নিজ চোখে দেখেছেন তিনি। ঠিকমতো বেতন না পাওয়াসহ নানা কারণে রিজেন্টে চাকরি করতে চাননি সোহাগ। সাহেদের সঙ্গে বিরোধের জেরে একদিন আরেফিন সোহাগকে উত্তরা পশ্চিম থানায় নিয়ে টানা আট ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এরপর সোহাগ রিজেন্টের চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যান। এরপর সোহাগের নামে চারটি মামলা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রিজেন্টের সাহেদ নিজে বাদী হয়ে উত্তরা-পশ্চিম থানায় সোহাগের নামে প্রতারণার মামলা করেন। সেই মামলায় সোহাগ ছাড়াও তাঁর বাবা-মাকে আসামি করা হয়। সাহেদের ভয়ে সোহাগ ঢাকা ছেড়েছেন।
সাহেদ
কোন মন্তব্য নেই